প্রবল বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে আমি মাওয়া ঘাটে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে ইলিশ কাটছি। ইলিশ চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কাটার জিনিস নয়, তারপরও কাটছি। মাঝে মাঝে মনের শান্তির জন্য কোপাকোপি করতে হয়।
আমি আঙুল কাটা জগলু। অনেকেই শুরুতে ভাবে আমার আঙুল হয়ত কাঁটা। আসলে কিন্তু তা নয়। আমি একসময় কচ কচ করে অন্যের আঙুল কাটতাম বলেই আমার এই নাম। আগে এক কোপে আঙুল কেটে ফেলতাম, এখন ইলিশ কাটছি। মতির ছোট ভাই, ইলিয়াস আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। এইটা ইলিয়াসেরই হোটেল। নাম কি দেখি নাই, বৃষ্টিতে নাম দেখার অবকাশ হয়নি। শেষবার চৌদ্দ বছর আগে যখন ইলিয়াসকে দেখেছিলাম, তখন একেবারে টিংটিঙে শুকনা ছিল। কিশোর ইলিয়াসের ঠোটের উপর হালকা মোচের আভাস দেখা যাচ্ছিল। এখন বেশ মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান।
কিছুক্ষণ আগেই মাত্র জেল থেকে ছাড়া পেয়েছি।
২০০৫ সালে যখন ধরা পড়ি তার প্রায় দু বছর পর বিচার শেষে আমার ফাঁসির আদেশ হয়। প্রেসিডেন্টের কাছে মার্সি পিটিশন করেছিলাম। কিন্তু লাভ হয় নি। ফাঁসির তারিখও ঠিক হয়ে গিয়েছিল কিন্তু সেই তারিখ আমাকে জানানো হয় নি।
পৃথিবীতে সবচয়ে বড় সত্য হচ্ছে প্রত্যেক সৃষ্টিকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে হবে। আবার সেই জন্মমৃত্যুর সময় সৃষ্টিকর্তার দ্বারা নির্ধারিত। কথায় বলে রাখে আল্লাহ মারে কে। আমার বেলাতেও তার প্রভাব দেখা গেল।
২০০৭ সালের শুরুতে ফাঁসির তারিখের ঠিক কিছুদিন আগেই বিশেষ ক্ষমতাধর এক রাজনৈতিক ব্যাক্তি তার এক বিশেষ কাজে আমার কাছে, মানে আঙুল কাটা জগলুর কাছে আসে। দেশের রাজনৈতিক অবস্থার তখন বেশ নড়বড়ে পরিস্থিতি। ঐ পরিস্থিতিতে আমার নিকট হতে একটা বিশেষ সহযোগিতার বিনিময়ে ফাঁসির পরিবর্তে আমার শ্বাস্থিকে ১৪ বছরের জেলে নিয়ে আসে। ফাঁসির আদেশের মার্সি পিটিশন একবার প্রেসিডেন্ট এর কাছ থেকে বাদ পড়লেও কপাল গুনে ফাঁসির কিছুদিন আগে পুনরায় পিটিশন করে আমার ফাঁসি মওকুফ হয়ে যায়।
২০০৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ১৪ বছর জেল শেষ করে আজ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকের বাহিরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছি আমি। আকাশ কালো মেঘে অন্ধকার হয়ে আছে, যেকোন ক্ষণে বৃষ্টি নামবে।
এমতাবস্থায় ফাঁকা রাস্তায় হাটা ধরলাম। পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মৃদু সুরে গান ধরলাম-
“আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে
ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে
জানি নে, জানি নে
কিছুতে কেন যে মন লাগে না, লাগে না
ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে”
এখন আমার প্রথম কাজ হচ্ছে মনসুর গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর মালিক মনসুর খানকে খোঁজে বের করা। ১৪-১৫ বছর আগে মেয়েকে নিয়ে কানাডায় সেটেল হয়ে গেলেও ব্যাবসার খাতিরে তাকে দেশে আসতে হয়। এই মনসুর খানই আমার ছেলে বাবুর বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট এর সব খরচ বহন করে। বাবু এখন তার সাথেই কানাডাতে আছে। ছেলের সাথে দেখা করতে হলে প্রথমে মনসুর খানের সাথে দেখা করা প্রয়োজন।
আপাতত আমি হাটছি ঢাকার উলটো দিকে, উদ্দেশ্য মাওয়া ঘাট। জেল থেকে মুক্তির পর এই মেঘলা দিনে খিচুড়ি, বেগুন ভাজা আর ইলিশের তুলনা হয় না। জেলে থাকতে শুনেছিলাম মতির ছোট ভাই ইলিয়াস নাকি মাওয়া ঘাটে স্পিড বোট চালায় আর মানুষজনকে পদ্মা সেতুর পিলার দেখাতে নিয়ে যায়। এই পিলার দেখাতে নিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা আমার মাথায় এখনও আসছে না। একটা ব্রিজের পিলার দেখার মাঝে এমন কি বা আছে, যার জন্য স্পিডবোট ভাড়া করে মানুষকে মাঝনদীতে ঘুরে আসতে হবে! এ পৃথীবিতে মানব সন্তানই হচ্ছে সবচেয়ে অদ্ভুত প্রাণী যাদের বহু কর্মকান্ডের মাঝে কোন যুক্তি কাজ করে না।
স্পিডবোট ছাড়াও ইলিয়াসের হোটেল আছে মাওয়া ঘাটে। ঐ এলাকায় ভালই প্রতাপ আছে মনে হয়। কারন তাকে ঐখানে ইলশা ইলিয়াস নামে চেনে।
হাটতে হাটতে মাওয়ার দিকে চলা একটা বাস পেয়ে উঠে গেলাম। যেইকোন মূহুর্তে বৃষ্টি নেমে পড়বে, এই বয়সে বৃষ্টি ভেজা ঠিক হবে না তাই আর হাটলাম না।
সেই বাসে করেই এলাম মাওয়াঘাটে। বলতে গেলে ইলিয়াসের ঠিকানা পেতে কোন কষ্টই হয় নাই আমার। মাওয়াঘাটের নামকড়া লোক সে, ইলশা ইলিয়াস।- ওই ইলিয়াস, তোর নাম ইলশা ইলিয়াস কেন রে?
– ভাই, কি যে করমু। মাইনষে এই নাম দিছে।
– আমার নাম জানস?
– জে ভাই, আপনে জগলু ভাই। ছোড বেলায় ভয়ে কাছে যাইতাম না।
– কিসের ভয়ে? আঙুলের ভয়ে?
– তহন তো ছোড আছিলাম ভাই। বুঝতাম না কিচ্ছু, এহন বুঝি আপনে দিলদরিয়া মানুষ। যেই মতি ভাইরে গেরামের মাইনষে কবর দেয় নাই। আজকে তার মাঝারে গিয়া শিরনি দেয়। সবই আপনের কারনে।
– আমি কিছু করি নাই, সবই তার ভাগ্য। আর এভারেস্ট ছেলেটার কান্ড।
– তুই আমাকে এভারেস্টের খোঁজ বের করে দিবি।
– ইভারেস্ট কেডা?
– ইভারেস্ট না, এভারেস্ট। ওর নাম, হিমালয়। হিমালয় থেকে হিমু, হিমু থেকে হি। তুই হিমু নামের হলুদ পাঞ্জাবী পড়া লোকের খোঁজ লাগা।
– জে ভাই খোঁজ লাগামু।
– আর তোর নামের কাহিনী তো বলস নাই। ইলসা ইলিয়াস কেন? ইলিশের হোটেল দেখে?
– আপনের কাছে কি লোকামু ভাই। আমি গোপন কাস্টমারের কাছে ইলিশের পেটে কইরা গোপন জিনিস বেচি। বড়লোকের বেটারা ওইসব বড়ই লাইক করে। তারা ইলিশরে ইংলিশে বলে ইলশা। ওই ইলশা থেইকাই বড়োলোকের বেটারা আমার নাম দিছে ইলশা ইলিয়াস।
– ইলিশের ইংরেজি নাম ইলশা না, হিলশা।
– জে ভাই, তাই তো কইলাম। ইলশা।
– হয় নাই, বল হিলশা ইলিয়াস।
– ইলশা ইলিয়াস।
– তুই এইদিকে আয়।
– জে ভাই।
– হাত রাখ এইখানে।
– জে ভাই।
– এখন বল, হিলশা ইলিয়াস। না পারলে এক কোপে আঙুল কাইটা ফেলব।
– জে ভাই, ইলশা ইলিয়াস।
– হয় নাই, চোখ বন্ধ কইরা বল হিলশা ইলিয়াস।
– জে ভাই, ইলশা ইলিয়াস।
আমি ইলিয়াসের দিকে তাকালাম। বন্ধ চোখ দিয়ে পানি নেমে আসছে তরতর করে। ভয় পেয়েছে ইলিয়াস। কিছু মানুষের জন্মই হয় তাদের মনিবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ভক্তি নিয়ে। মতি আমার ওইরকম ভক্ত ছিল। ইলিয়াসও মতির মতই ভক্ত। ইলিশের ভেতর ড্রাগস স্মাগল করে সে। এইরকম কাজ করতে সাহস লাগে। সেই সাহসী ইলিয়াস আমার মত ৫০ বছরের বুড়োকে ভয় পাচ্ছে। ভয়টা শুধু ভয় না, শ্রদ্ধা ভক্তি মিশ্রিত ভয়।
ইলিয়াসের বিশ্বাস আঙুল কাঁটা জগলু ইলিয়াসের হাত কাটবে না। মতির মত সেও মতির উত্তরসরি হিসেবে আঙুল কাঁটা জগলুর ডানহাত ভাবে নিজেকে। কেউ নিজের হাতের আঙুল কাটবে না, তাই চোখে জ্বল এলেও ইলিয়াস নিশ্চিন্তে আছে।
আমি ইলিয়াসের হাতে পিস পিস করা ইলিশ দিয়ে বললাম,
– বেটা এইগুলা ভাল করে ভেজে পোলাও চালের খিচুড়ি বানিয়ে নিয়ে আয়। সাথে বেগুন ভাজা। জেল থেকে মুক্তির পর কিছু খাই নাই। তোর হাতের বানানো খাবার দিয়েই নতুন জীবন শুরু করব। এখন কান্না থামিয়ে দূর হ। আমার কান্না-কাটি পছন্দ না।
– জে ভাই, আপনে এহনো খালিপেডে। আমি অক্ষন খিচুড়ি বানাইয়া আনতেছি।
ইলিয়াসের চেহারায় এখন হাসি। কিন্তু চোখের পানি বন্ধ হয় নাই। হাতে মাছের টুকরো বলে চোখ মুছতে পারছে না। সে দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে গেল।
রান্নাঘর থেকে তার কথা ভেসে আসছে। ওই মন্টু, কইরে। জলদি পোলাও চালের স্পেশাল খিচুড়ি বসা। টেস্ট না অইলে তোর চাকরী নট। জগলু ভাই আমার হোটেলে খিচুড়ি খাইব! জলদি কর!
আর, আমি পদ্মা পাড়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে অপেক্ষা করছি নতুন একটা দিনের।
হুমায়ূন আহমেদের আঙুল কাটা জগলু থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে।