আমার নাম রাহাত, ভাল নাম রাহাত হাসান। ঢাকায় একটা ছোট-খাট এনজিও-তে চাকরি করি। ঢাকায় চাকরি করি জিনিসটা আসলে বলার জন্য। দেখা যায় বছরের বেশিরভাগ সময়টাতেই অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে কাটাইতে হয়। গত ৫ দিন ধরে অফিসেরই এক বিশেষ কাজে রাঙামাটি আছি। অবশ্য একা নই, আমার সঙ্গে আছে মজিদ ভাই। কোথায় আছি সেইটা বলছি না, কারন কনফিডেন্সিয়াল ব্যাপার সেপার আছে। আজ বুধবার সারাদিন শুধু কাজের উপর দিয়েই আছি। এর মধ্যে মজিদ ভাই আবার বুলেট ট্রেনের গতিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দুইজনেরই লক্ষ আজ রাতের মধ্যে সব কাজ শেষ করে কাল সকাল সকাল একটা ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে ঢাকায় ফেরত যাব। কাজেই সকাল, দুপুর আর রাতের খাবার সময়টা বাদ দিয়ে প্রায় একটানা কাজ করতে করতে রাত ১২ টা ১৭ এ এসে আমরা ক্ষান্ত হয়েছি। আমি অবশ্য সন্ধ্যায় ঘন্টা দেড়েক ঘুমাইলেও মজিদ ভাই এর টানা ঘুম নেই। গত দুইদিনে সে মাত্র ৩-৪ ঘন্টার মত ঘুমিয়েছে। এখন আমাদের দুইজনেরই একটু ঘুম দেওয়া দরকার। তবে ঘুমাবার আগে ভাবলাম একটু বাহিরে হেটে আসি। অফিসার্স কোয়ার্টার এর ১৪ নম্বর এর এই বদ্ধ ঘরে সারাদিন থাকতে থাকতে মাথা ভোতা হয়ে গেছে।
রাত বাজে এখন ১২টা ৪৩। আমি আর মজিদ ভাই ভাই অফিসার্স কোয়ার্টার এর বারান্দায় দাঁড়িয়ে কালো মেঘের আড়ালে ভাঙা চাঁদের লুকুচুরি খেলা দেখছি। আজ বিকেলে এইদিকটায় বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টির পর যেই মৃদু ঠান্ডা বাতাসটা আসছিল সেইটা এখন মধ্যরাতে আরো শীতল হাওয়ায় পরিনত হয়েছে। এই মুহুর্তে এক কাপ চা-কফি হলে মন্দ হত না। এত রাতে হয়ত চা পাওয়া যাবে না তাও আমরা বটতলায় রওনা দিলাম। যদিও যায়গাটায় কোন বটগাছ নেই, একটা বিশাল শিল-কড়ই গাছ আছে। কিন্তু নতুন যায়গার নামধাম জানিনা বলে আমি এইটা বটতলা বলেই ডাকি। শুরুতে ভেবেছিলাম কড়ইতলা বলব, কিন্তু কড়ইতলা নামটা আসলে যায় না। তাই বটতলাই ফাইনাল করেছি।
তো চা-কফি কিছু একটা খাওয়ার মতলবে আমরা আমাদের কথিত সেই বটতলায় রওনা দিলাম। অফিসার্স কোয়ার্টার থেকে প্রায় ৫-৬ মিনিটের হাটার পথ। কিছুদুর যাবার পর একটা কাল-কুকুর আমাদের সঙ্গী হল। বেশ বড় সাইজের কুকুর। দেখেই শার্লক হোমস এর হাউন্ড অব দ্যা বাস্কারভিল এর কথা মনে হল। অভ্যেস মত পকেট থেকে মোবাইল বের করে আবার সময় দেখলাম। রাত ১ টা বেজে ৩ মিনিট। সামনের মোড় থেকে ডানে গেলেই বটতলা আর ২-১ মিনিটের পথ। তো আমরা মোড় থেকে ডানে চলতে লাগলাম। এখন সেই কাল-কুকুরটাও আমাদের সাথে সাথে ডানে চলা শুরু করল। মজিদ ভাইয়ের অবশ্য কুকুরের দিকে খেয়াল আছে বলে মনে হয় না। সে তার মত করে আমার সাথে কথা বলে যাচ্ছে আমিও, তার সাথে কথা বলতে বলতেই হাটছি। তবে এত রাতে এইরকম বিশাল সাইজের কুকুর দেখলে যে কোন মানুষেরই মনে শঙ্কা জাগবে কখন আবার কামড়ে দেয়।
হাটতে হাটতে হঠাত খেয়াল করলাম আমরা যেই মোড় থেকে ডানে গিয়েছি সামনে আবার সেই মোড়টা চলে এসেছে। অথচ এই মুহুর্তে হিসেব মতে এইখানে বটতলা আসার কথা। সেই কাল-কুকুরটাও আমাদের পাশেই হাটাহাটি করছে। এইবার মজিদ ভাইয়ের মনেও খটকা লাগল। মোবাইলের ঘড়িতে তাকালাম, রাত ১ টা ১৪ বাজে। আরও ৫-৭ মিনিট আগেই আমাদের বটতলায় থাকার কথা। যাই হোক আমরা দুইজন আবারও ডান দিকে হাটা দিলাম। গত ৫দিন ধরে এই পথেই যাচ্ছি বটতলায়। কোন সমস্যা হয়নাই, অথচ আজ কেমন কেমন জানি লাগছে। আমি মজিদ ভাইকে বললাম-
-> “ভাই, চলেন ফেরত যাই। এত রাতে চা পাওয়া যাবে না। তাছাড়া রাস্তায়ও কেউ নাই।”
=> আরে, সমস্যা নাই ভাই। এত দূর যখন আসলাম, আর ১ মিনিট হাটলেই হবে।
-> ভাই, গত ২০-২৫ মিনিট ধরে হাটছি। বটতলার খবর নাই। এর মধ্যে এই বাস্কারভিলের হাউন্ডটাও পিছু ছাড়ছে না।
=> সমস্যা নাই ভাই, এইটা এইখানকার পাহারাদার কুকুর হবে। দেখলেন না, একবারও ঘেউ ঘেউ করে নাই। শান্ত একটা কুকুর। ভয় পাবার কিছু নাই।
অতঃপর, আমরা হাটতে লাগলাম। কিন্তু বটতলা আর আসে না। মোবাইলে তাকালাম, রাত ১টা ৩৬ মিনিট। কিছু একটা ঘাপলা অবশ্যই আছে। এইবার মজিদ ভাইয়ের চেহারায়ও শঙ্কার ছায়া দেখলাম। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এইবার ফেরত যাওয়া উচিত। অনেক রাত হয়ে গেছে, রুমে গিয়ে ঘুমাবার দরকার।
যেই পেছনে ফিরে হাটা ধরলাম কুকুরটা আমাদের পথ আটকে দাড়াল আর ঘড়ড়ড়ড়ড়-ঘড়ড়ড়ড় জাতীয় শব্দ করতে লাগল। আমরা কুকুরটাকে পাত্তা না দিয়ে হাটতে লাগলাম। কিন্তু কুকুরটা আমাদের সাথে এইবার অশান্তভাবে চলতে লাগল আর ঘড়ড়ড়ড়ড়-ঘড়ড়ড়ড় জাতীয় শব্দ করতে লাগল। ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে কুকুরটা চাইছে না আমরা এই পথে যাই।
=> ভাই, একটা লাঠি পাইলে ভাল হইত, মনে হয়। মজিদ ভাই বলল।
-> আমিও তাই ভাবছি। কুকুরটা সুবিধার মনে হচ্ছে না।
=> হুম, হঠাত কামড়ে দেয় নাকি সেই টেনশনে আছি।
এমন সময় হঠাত কুকুরটা লাফ দিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। ভাবখানা এমন, আমাদের আর সামনে যাইতে দিবে না। আমি আর মজিদ ভাই, একটু ধমক টমক দিয়ে কুকুরটাকে পাস কাটিয়ে সামনে হাটতে লাগলাম। কুকুরটা অনবরত ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে এখন, কিন্তু আমাদের পিছনে আর আসছে না। মজিদ ভাই বলল – “হয়ত কুকুরটার এরিয়া শেষ, তাই আসছে না। চিন্তার কিছু নাই।”
হঠাত আমার মনে হল, এই মাত্র আমার পাশ দিয়ে কে যেন হেটে গেল। গা কেমন শির শির করে উঠল। আমি মজিদ ভাই এর দিকে তাকালাম। ভাইও মনে হয় কিছু একটা অনুভব করছে। আমি বললাম –
-> ভাই, কিছু সমস্যা আছে মনে হচ্ছে। বুঝতে পারছি না। কোথাও কিছু একটা ঘাপলা আছে।
=> সমস্যা নাই ভাই। আর দুই মিনিট হাটলেই অফিসার্স কোয়ার্টার এ চলে আসব।
-> ভাই, ১ তা ৫০ বাজে এখন। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
হঠাত আমাদের সামনের রাস্তাটা ঘুটঘুটে কাল অন্ধকার হয়ে এল। এত অন্ধকার মনে হয় আমাবস্যাতেও দেখা যায় না। আমি মজিদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। দুইজনই বুঝতে পারছি, সামনে কোন একটা সমস্যা আছে। এতক্ষন আমরা যেই কুকুরটাকে ভয় পাচ্ছিলাম আসলে সেইটা সমস্যা ছিল না, সমস্যা হচ্ছে আমাদের সামনে অন্ধকার কাল কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে যার কাছ থেকে কুকুরটা আমাদের দুরে সরিয়ে রাখতে চাচ্ছিল। মজিদ ভাইয়ের চোখের ইশারাতেই বুঝে গেলাম কি করতে হবে।
মজিদ ভাই আর আমি উলটো একটা দৌড় দিলাম। আমাদের টার্গেট কোনভাবে ওই কুকুরটার কাছে পৌছাতে হবে।
আমি আর মজিদ ভাই দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি, পথ মনে হয় শেষই হচ্ছে না। কুকুরটা আর মাত্র ১০ ফুটের মত দূরে মনে হচ্ছে। এমন সময় আমার মাথা ঘুরে উঠল হঠাত। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল তরলের স্রোত বেয়ে গেছে মনে হল। হঠাত আমি হুমুড়ি খেয়ে পড়লাম। পরক্ষনে উঠে পেছনে তাকালাম, আর বুঝতে পারলাম আমি জীবনের সবচাইতে ভয়ংকর একটা কাজ করে ফেলেছি। আমার সামনে এক ভয়ংকর চেহারার মানুষ দাড়িয়ে আছে। আসলে পুরুপুরি মানুষও বলা যাবে না। শত বছর বয়স্ক বৃদ্ধের মত ভাজ পড়ে যাওয়া চেহারার মধ্যে দুইটা আগুনের গোলার মত চোখ। এমনই ভয়ংকর যা আসলে কেউ নিজে না দেখলে বুঝতে পারবে না। সেই চোখে চোখ রাখতেই আমার মনে হচ্ছিল আমি নিজের নিয়ন্ত্রনে আর নেই। আমি বুঝতে পারছি, আমার পেছনে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমি সামনের দিকে হেটে যাচ্ছি। মজিদ ভাই আমাকে ডাকছে সেই আওয়াজ মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। সমুদ্রতীরে যেমন একটা শো শো শব্দ হয় আমিও সেই শব্দ শুন্তে পাচ্ছি। এরপর আর আমার কিছু মনে নাই।
চোখ খুলতে দেখলাম মজিদ ভাই আমার মাথায় পানি ঢালছে। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম আমি অফিসার্স কোয়ার্টার এ আমাদের সেই ১৪ নম্বর কক্ষে শুয়ে আছি। পাশে মজিদ ভাই বালতি ভরে পানি নিয়ে এসে আমার মাথায় ঢালছে।
-> ভাই, কয়টা বাজে? মজিদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম।
=> আরে ভাই, আপনার কি আর টাইম জানা ছাড়া কাজ নাই। বড় বাঁচা বাইচা গেছেন। কুকুরটা না থাকলে আপনিও যাইতেন, আমিও যাইতাম।
-> কি হইছিল ভাই?
=> হইছে কিছু একটা। আপনি এখন ঘুমান। আমিও ঘুমাই। কালকে এইখানে আর থাকা যাবে না। বড্ড বাঁচা বাচলাম।
মনে করার চেষ্টা করতে থাকলাম ওইখানে আমার সাথে কি হয়েছিল। একটা অন্ধকার ছায়া আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। কোন এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আমি সেই ছায়ার পিছু পিছু হাটা শুরু করেছিলাম। মজিদ ভাই আমাকে অনেক ডাকছিল, আর আমি সেই ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি আমার নিয়ন্ত্রণে ছিলাম না। মনে হচ্ছিল দূর থেকে ঘুমপাড়ানি কোন শব্দ ভেসে আসছিল। ধীরে ধীরে মজিদ ভাইয়ের ডাকার শব্দও মিলিয়ে যাচ্ছিল। তখন হঠাত দেখি সেই কুকুরটা ছায়াটার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।
সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর মজিদ ভাইকে রুমে দেখলাম না। হয়ত ব্রাশ করতে করতে বাহিরে গেছে। যাই হোক আমি ঢাকা ফেরার প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। মজিদ ভাই আসলে না হয় তার জিনিসপত্র গোছাবে। সব গুছিয়ে গোসল করে আমি তৈরি, কিন্তু মজিদ ভাইয়ের কোন খবর নাই। এমনটা হবার কথা না। নাস্তা করতে যাওয়া উচিত। মজিদ ভাইকে ফেলে যাব সেইটাও কেমন জানি লাগছে। ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পর বাহির হলাম নাস্তা করার উদ্দেশ্যে। সেই বটতলার দিকেই যেতে হবে। রাতের কথা মনে হতেই গাইয়ে কাটা দিয়ে উঠল। যাই হোক, মজিদ ভাইয়ের জন্য আর অপেক্ষা না করে নাস্তা করতে রওনা দিলাম। কিছু দূর যেতেই সামনে একটা মানুষজনের জটলা দেখলাম। কাছাকাছি যেতেই হঠাত এক বিতিত্র ভয়ে গা-কাঁটা দিয়ে উঠল। কেউ যেন বলছিল – “সামনে যেও না, সামনে বিপদ”! আমি তাও সাহস করে সামনে গেলাম, ভিড় ঠেলে গিয়ে দেখলাম সামনে মজিদ ভাইয়ের লাশ। কেউ একজন মজিদ ভাইয়ের চেহারা ভয়ংকর ভাবে খামচে রেখেছে। আমার মাথা কেমন জানি ঝিম ঝিম করে উঠল। এর পর আমার আর কিছু মনে নেই।
পরিশিষ্ঠঃ ওই ঘটনার প্রায় দুইদিন পর আমার জ্ঞান ফিরে। জ্ঞান ফেরার পর আমি নিজেকে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে পাই। ঢাকা থেকে বড় স্যার সহ অনেকেই আসে পরিস্থিতি দেখতে। ঘটনার পর অনেকবার পুলিশের কাছে আমার জবানবন্দী দিতে হয়, তবে পুলিশ তা গ্রহন করেনি। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কোন হিংস্র প্রাণীর আক্রমনে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে এবং মৃত্যুর সময় রাত ২ঃ০০ থেকে ২ঃ৩০ এর মধ্যে বলা হয়েছে। আমার মনে এখনও একটা খটকা রয়ে গেছে, যদি রাত ২ঃ০০ থেকে ২ঃ৩০ এর মধ্যে মৃত্যু হয় তাহলে আমাকে বাসায় কে দিয়ে যায়!